ঝর্ণার খোঁজে পাথাড়িয়ার বুকে | পাথাড়িয়া হিল-ট্রাক্টস ট্রেকিং
বিশাল বড় এক অজগরের তাড়া খেয়েই শুরু হলো আমাদের পাথাড়িয়ার ঝর্ণা জয়ের যাত্রা। চা বাগানের বড় বাবু মানে ম্যানেজার সাহেব তার বাগানের সেরা চা দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করতে করতে বলেছিলেন যে ওদিকটাতে নাকি স্থানীয়রা তেমন কেউ যায় না, কারন বিভিন্ন ধরনের ভয়ে ভরপুর এক জায়গা। তবুও আমাদের অদম্য আগ্রহের কারনে ম্যানেজার সাহেব একজন গাইড দিয়ে দিলেন, তার নাম বলরাম। বলরাম লম্বার ছয় ফুটের একটু বেশি হবে, বুক ৪৬ ইঞ্চি চওড়া আর তার সাথেই তাল মিলানো চওড়া কাধ। হাতের পেশিগুলো পাহাড় পাথড়, আর গায়ের রঙ মরচে ধরা ইস্পাতের মতো তামাটে। স্বভাবে গম্ভীর হলেও পাকানো মোচ নেই ওর। এই রকম একটা দানব শারীরিক মানুষও গলায় পরেছে তাবিজ, কারন ঐ একই… চির চেনা জঙ্গলের চির অচেনা এক ভয়।
ট্রেকিং এর শুরুর পথটা কিছু দুর ম্যানেজার সাহেব নিজেই এগিয়ে দিলেন, এক গাল হাসি সাথে শুভ কামনা করে বিদায় দিলেন। ম্যানেজার সাহেব আমাদের সঙ্গী বা বলরামকে যেভাবে বলে দিয়েছিলেন সেভাবেই সে আমাদের পথ দেখিয়ে চলতে লাগল, সাথে আমরা।
প্রথমে পাড়ি দিতে হলো ছোট বড় কয়েকটি টিলা সমৃদ্ধ বিশাল একটি চায়ের বাগান, পরে নিচের দিকটাতে নামা শুরু করলাম। শুরুতেই আমাদের কয়েকজনকে বিশাল বিশাল ভয়ংকর সব জোকের আক্রমন হলেও আমরা সফলতার সাথে পার পেয়ে গেলাম, অজানা ভয় হেরে যায় অজানাকে ভয় করার নেশায়। নিশ্চুপ বাগানের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দেয় দূর থেকে ভেসে আসা পাখির চিরচির শব্দ, ভালো অনুভুত হলেও অজানা এক ভয়ের ভর যেন ছেড়েই যেতে চাচ্ছিল না। বাগান, টিলা একটির পর একটি পাড়ি দিয়ে প্রথম নিচে দিকে বা জঙ্গলের উদ্দেশ্যে যাত্রার শুরুতেই পেয়ে গেলাম ঝর্ণার অবগাহন ঝিরি পথ; শীতল পানির পরশ প্ররিশ্রান্ত পায়ে এনে দিল এক নির্মলতা তাতে আমাদের হাটার স্পৃহা দ্বিগুন হয়ে গেল। জঙ্গলের শুরুতেই অন্ধকার, লতা, পাতা গুল্ম সব সরিয়ে নিজেরাই যাওয়ার পথ করে নিচ্ছিলাম। হাটার এক পর্যায়ে আমাদের বলিষ্ঠ গাইড সবাই থামিয়ে দিয়ে হাতের আঙ্গুলের ইশারায় চুপ থাকতে বলল; সাপ, অজগর। নিমিষেই আমরা চুপশে গেলাম কিন্তু আমাদের দলের অন্যতম মিতভাষী সাহেদ নির্দীধায় সাপটিকে ধরে একটু ধুরে সরিয়ে দিল, আহা কি শান্তি আমাদের মনে ফিরে এলো।
আবার চলা শুরু, ঝিরি পথ, বিভিন্ন পাখির কলকাকলী সাথে শান্ত নিঝুম পরিবেশ। প্রথম ঝর্ণার দেখা মিললো ঘন্টাখানেক পরেই। দ্বিতীয় ঝর্ণার উদ্দেশ্যে চলা শুরুর পরপরই দেখা মিললো বন্য হাতির বিশাল একটা দল, আমরা থেমে গেলেও তুষার কি আর থামার বান্দা… ছুটে গেল হাতির কাছে সেলফি তুলবে বলে। তুষার যতোই দুষ্টু হোক হাতি তো হাতিই ধাওয়া করল আমাদের। ছুটতে ছুটতে ইউটিইউব সার্চ করলাম “হোয়াট টু ডু টু বি সেইফ ফ্রম বন্য হাতি” ইন্টারনেট স্লো হওয়ার অনেক ক্ষন খুজতে হলো। টিওটোরিয়ালটি পাওয়ার পর এপ্লাই করা সুযোগ পায়নি কারন ততক্ষনে আমরা দ্বিতীয় ধর্নার দেখা পেয়ে গেছি আর হাতি অনেক আগেই আমাদের পিছু করা থামিয়ে দিয়েছে, হাতিও তো ক্লান্ত হয়!!! হাতিরা তো আর ট্রেকিং করবে বলে তরনের মতো প্রতিদিন বাসা-অফিস-বাসা হাটার প্রাক্টিস করে না!!!
যে দিন প্রথম ঠিক হলো আমরা পাথারিয়া ট্রেইল ট্রেকিং করবো তখন থেকেই এমন সব আজগুবি ভাবনা মাথায় আসতে থাকে, আমিও প্রশ্রয় দিয়েছি মজা পাই তাই… আসল চিত্র এই ভিডিওতে আছে;
সরাসরি YouTube এ দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
ঢাকা থেকে যেতে চাইলে আরামবাগ বাস স্ট্যান্ড থেকে উঠতে হবে (আগে ভাগেই টিকিট কিনে রাখা ভাল, টিকিটের মূল্য ৪০০ – ৫০০ টাকা) বাসে, সোজা বড়লেখা। বড়লেখা সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার অন্তরভুক্ত, যাওয়ার জন্য তিনটি বাস পাবেন; শ্যামলী, এ্যানা, ও সোনার বাংলা। সবই চেয়ার কোচ, চেষ্টা করবেন সোনার বাংলা এভোয়েড করার জন্য। বাসের কন্ডাক্টরকে আগে ভাগেই বলে রাখতে হবে বড়লেখার তিনরাস্তার মোড়ের আগে দক্ষিনবাগ নামিয়ে দিতে হবে যেখান থেকে সিএনজি অটো রিক্সা (২০০ টাকা) করে সমনবাগ কেন্দ্রীয় হাসপাতালের সামনে নামতে হবে। আমরা যদিও ভুল করে বড়লেখা তিন রাস্তার মোড়ে নেমে পড়ি, শুক্রবার আবার বেশি সকাল হওয়ায় সিএনজি পাওয়া খুব কঠিন। একটু অপেক্ষা (ফাকে সকাল সকাল চা দিয়ে শুরু করি ট্রেকিং শুরুর উদযাপন) করে পেয়ে যায় গরু বহনকারী একটি পিকআপ ভ্যান, তাই সই!!! সাথে নাস্তা নিতে ভুল করায় বিপদে পড়ি কারন সমনবাগ চা বাগানের ভেতরে কোন হোটেল নেই, যা আছে তাতে ডাল-পুরি আর ছোলা পাওয়া যায়। সরাসরি ওখান থেকেই গাইড নিতে হবে, গাইডের জন্য যোগাযোগ করতে হবে ধ্রুবোর সাথে। ধ্রুব এ্যাডভেঞ্চার প্রিয় খুব ভালো ছেলে, ওদের বাসায় ওর মায়ের হাতে চা খেলাম সাথে বিস্কুট। পরে গাইড পাপনকে সাথে নিয়ে রওনা হলাম।
শুরুতেই পেয়ে যাবেন বামে সমনবাগ চা বাগান আর ডানে পাথাড়িয়া চা বাগান। মিনিট পনেরো এগোতেই দেখা মিলবে ছোট ছোট জোকের, এরা অতিথিপরায়ন তাই এরা নিজ দ্বায়িত্বে আপনার রক্তের গন্ধে আপনার দিকে এগিয়ে আসবে। জোক থেকে বাচার জন্য পায়ে বা সারা শরীতে মেখে নিতে পারেন পেট্রোলিয়াম জেলি।
গাইডের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে এই চারটি ঝর্ণা দেখতে হলে নিচের স্থানগুলো ট্রেক করে যেতে হবে;
চা বাগানের টিলা, ২৬ পাহাড়, পাচাচাওনি পাহাড় এর পর বোলছড়া ঝর্ণা, পরে বান্দরডুবা ঝর্না, খাশিয়া কুন্ডু টিলা, কালা পাহাড়, বাদশা পাহাড় শেষে রজনী কুন্ডু ঝর্ণা। (সঠিক নামগুলো সংগ্রহে এনে ঠিক করে দিতে পারব)।
যারা হাটতে অনভ্যস্ত তাদের জন্য ৭.৫ ঘন্টা হাটতে হবে, আর যারা অভ্যস্ত তাদের জন্য ৫ ঘন্টা যথেষ্ঠ। সাথে রাখবেন শুকনো খাবার, পর্যাপ্ত পানি ও চকলেট, খাবার সালাইন। ম্যালেরিয়ার ঔষধ যাত্রাশুরুর আগেই খেয়ে নেওয়া ভাল, অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নিবেন। সাথে একটা টর্চ নিয়ে নিতে পারেন কিন্তু বাশের লাঠি নিতে ভুলবেন না। খাড়া পাহাড় থাকবে পরপর, বন্য হাতির ভয় থাকছে, আর হ্যা অজগরের দেখা প্রায় অসম্ভব হলেও পিট ভাইপার সহ বিভিন্ন সাপের দেখা স্বাভাবিক। বর্ষায় পিচ্ছিল থাকে তাই সাবধানতা অত্যাবশ্যক, ট্রেকিং স্যান্ডেল আবশ্যক সাথে গামছা।
এটা পর্যটন এলাকা নয়, দুর্গম পথ। চিপ্স বা খাবারের প্যাকেট দিয়ে নোংরা করবেন না, লোকাল মানুষদের সাথে সুসম্পর্ক রাখবেন। যেখানে সেখানে মূত্র ত্যাগে বসলে খেয়ার রাখবেন জোকের দিকে। জোকের ভয় এমন একটি ভয় যা আপনাকে সাদ্দামের মতো বানিয়ে দিতে পারে, জোক না ধরলেও জোক সে ফিল করেছে… তুষার সাক্ষী!!! হাটতে কষ্ট হলেও মুখ দিয়ে নিশ্বাস নিবেন না বা ছাড়বেন না, অবশ্যই নাক দিয়ে নিশ্বাস নেওয়া ও ছাড়ার কাজটি করবেন তাতে দোম বাড়বে বৈকী কমবে না। ঝরার পানি পান করতে পারবেন কিন্তু সাবধানে।
কিছু ছবিঃ
প্রকৃতির সান্নীধ্যে প্রকৃতিকে উপভোগ করুন। আগে বাংলাদেশ ঘুরে দেখুন পরে বিদেশ।
শুভ কামনা।